কোচবিহার: পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার অনেক কৃষক বর্তমানে এক অদ্ভুত সমস্যার সম্মুখীন। একদিকে রাজ্য সরকারের কৃষক বন্ধু প্রকল্প তাদের হাতে আর্থিক সহায়তা তুলে দিলেও, অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প প্রধানমন্ত্রী কিষান সম্মান নিধি যোজনার সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। কেন এমনটা হচ্ছে? সরকারি নিয়ম কানুনের বেড়াজাল নাকি অন্য কোনো সমস্যা? এই প্রতিবেদনে আমরা কোচবিহারের কৃষকদের এই পরিস্থিতি এবং এর পেছনের কারণগুলো খতিয়ে দেখব।
PM Kisan: সমস্যা কোথায়?
কৃষকবন্ধু প্রকল্প 2024 | KrishakBandhu Status check 2024
প্রধানমন্ত্রী কিষান সম্মান নিধি প্রকল্পের আওতায় যোগ্য কৃষকদের বছরে ৩ কিস্তিতে মোট ৬ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা সরাসরি তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়। দেশের প্রান্তিক কৃষকদের আর্থিক সচ্ছলতা নিশ্চিত করাই এই প্রকল্পের লক্ষ্য। কিন্তু কোচবিহার জেলায় বহু কৃষক অভিযোগ করছেন যে তারা এই প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছেন না।
আগে, ২০১৯ সালের ১লা ফেব্রুয়ারির আগে যে সকল কৃষকের জমির খতিয়ান কম্পিউটারে নথিভুক্ত হয়েছিল, প্রাথমিকভাবে তারাই এই প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেয়েছিলেন। তবে বর্তমানে সমস্যাটি শুধু এই তারিখের নিয়মের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। কৃষি দপ্তরের আধিকারিকদের মতে এবং সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বহু কৃষক PM Kisan এর টাকা পাচ্ছেন না মূলত কিছু বাধ্যতামূলক কাজ সম্পন্ন না করার কারণে। এর মধ্যে অন্যতম হলো:
১. ই-কেওয়াইসি (eKYC) সম্পন্ন না করা: এই প্রকল্পের সুবিধা পেতে প্রত্যেক সুবিধাভোগী কৃষকের জন্য ই-কেওয়াইসি করা বাধ্যতামূলক।
২. ল্যান্ড সিডিং (Land Seeding) না হওয়া: জমির রেকর্ডের সাথে আধার এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সংযোগ (Land Seeding) সঠিকভাবে না হলেও টাকা আটকে যায়।
৩. আধার-ব্যাংক অ্যাকাউন্ট লিঙ্ক: সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা আসার জন্য আধার কার্ডের সাথে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সংযুক্তিকরণ এবং DBT (Direct Benefit Transfer), বা AePS (AePs stands for Aadhaar Enabled Payment System) সক্রিয় থাকা জরুরি।
৪. তথ্যের ভুল: আবেদনপত্রে বা রেকর্ডে নাম, আধার নম্বর, ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্যে গরমিল থাকলেও সমস্যা হয়।
৫. যোগ্যতার শর্ত পূরণ না করা: আয়কর প্রদানকারী বা নির্দিষ্ট পেশার সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা এই প্রকল্পের যোগ্য নন।
কোচবিহারের জেলা কৃষি দপ্তরের ডেপুটি ডিরেক্টর অফ অ্যাগ্রিকালচার (প্রশাসন) অসিতবরণ মণ্ডল জানান, কেন্দ্রীয় সরকারের কঠোর নির্দেশিকা মেনেই প্রকল্পের কাজ করতে হচ্ছে, ফলে আবেদনকারী সকলের নাম প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। মূলত উপরোক্ত শর্তগুলি পূরণ না করার ফলেই বহু আবেদন আটকে আছে।
সংখ্যায় কে এগিয়ে? Krishak Bandhu না PM Kisan?
কেন্দ্রীয় প্রকল্পের এই কঠোর নিয়মের গেরোয় যখন বহু কৃষক বঞ্চিত হচ্ছেন, তখন রাজ্য সরকারের কৃষক বন্ধু প্রকল্প অনেকটাই বেশি সংখ্যক কৃষকের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে। কোচবিহার জেলায় প্রায় ৪ লক্ষ ৩০ হাজার কৃষক রাজ্য সরকারের কৃষক বন্ধু প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছেন। অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছেন তুলনামূলকভাবে কম, প্রায় ২ লক্ষ ৫২ হাজার কৃষক (এই সংখ্যাটি পূর্বের তথ্যের ভিত্তিতে)।
কৃষক বন্ধু প্রকল্পে কৃষকদের বছরে দুই কিস্তিতে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। এক একর বা তার বেশি জমি থাকলে বছরে মোট ১০ হাজার টাকা এবং এক একরের কম জমি থাকলে বছরে মোট ৪ হাজার টাকা সরাসরি কৃষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা করা হয়। এই প্রকল্পের নিয়ম তুলনামূলকভাবে সরল হওয়ায় বেশি সংখ্যক কৃষক এর আওতায় এসেছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রান্তিক কৃষকরা মনে করেন, যদি উভয় প্রকল্পের সুবিধা তারা পেতেন, তাহলে আর্থিক অনটন অনেকটাই কমত।
রাজনৈতিক তরজা
কোচবিহারের তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ জগদীশচন্দ্র বর্মা বসুনিয়া কেন্দ্রীয় প্রকল্পের এই পরিস্থিতিকে ‘ভাঁওতা’ আখ্যা দিয়েছেন। তার অভিযোগ, রাজ্য সরকার কৃষকদের পাশে থাকলেও কেন্দ্রের নিয়মকানুনের জটিলতার কারণেই বহু প্রান্তিক কৃষক PM Kisan প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
কৃষকের মুখে কষ্টের কথা
মাথাভাঙ্গা-২ ব্লকের বাসিন্দা জমিলা বেওয়া নামে এক প্রান্তিক কৃষক আক্ষেপ করে বলেন, “কৃষক বন্ধু প্রকল্পের টাকা পেয়েছি। রাজ্য সরকার আমাদের পাশে আছে। কিন্তু পিএম কিষান সম্মান নিধির টাকা পাইনি। ওই টাকাটা পেলে চাষের কাজে খুব সুবিধা হত, সংসারের চাপ কিছুটা কমত।”
সমাধানের পথ কী?
সাতমাইল সতীশ ক্লাবের সম্পাদক অমল রায়, যিনি কৃষকদের নিয়ে কাজ করেন, জানান যে বহু কৃষক PM Kisan এর টাকা না পেয়ে হতাশ। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন যাতে এই প্রকল্পের নিয়মকানুন আরও শিথিল করা হয়, যাতে প্রকৃত প্রান্তিক কৃষকরা সহজে এর সুবিধা পেতে পারেন।
কৃষকদের নিজেদেরও কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। PM Kisan পোর্টাল বা নিকটবর্তী কৃষি অফিসে যোগাযোগ করে তাদের eKYC, ল্যান্ড সিডিং এবং আধার-ব্যাংক অ্যাকাউন্ট লিঙ্কের স্ট্যাটাস চেক করা উচিত। কোনো সমস্যা থাকলে তা দ্রুত সমাধান করার চেষ্টা করতে হবে।
কোচবিহারের কৃষকদের এই সমস্যা শুধুমাত্র এই জেলার নয়, রাজ্যের অন্যান্য প্রান্তেও একই চিত্র দেখা যায়। একদিকে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের জটিল নিয়ম বা বাধ্যতামূলক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে না পারা, অন্যদিকে রাজ্য প্রকল্পের সরলতা – এই দুইয়ের মাঝে পড়ে বহু প্রান্তিক কৃষক তাদের প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার যদি যৌথভাবে কৃষকদের এই সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হয় এবং প্রকল্পের প্রক্রিয়াগুলো আরও সহজ ও স্বচ্ছ করে তোলে, তাহলেই প্রকৃত অর্থে কৃষকদের মুখে হাসি ফুটবে। আশা করা যায়, দ্রুত এই সমস্যার সমাধান হবে এবং সমস্ত যোগ্য কৃষক তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী আর্থিক সহায়তা পাবেন।