কৃষক বন্ধু প্রকল্পে নিয়মের ফাঁক: বেনোজল ঢুকে পড়ল সরকারি সহায়তার খাতায় -নজরদারি কৃষিদপ্তরের

কৃষক বন্ধু প্রকল্পে নিয়মের ফাঁক: বেনোজল ঢুকে পড়ল সরকারি সহায়তার খাতায় -নজরদারি কৃষিদপ্তরের। কৃষিই আমাদের দেশের মেরুদণ্ড। বাংলার অর্থনীতির চালিকাশক্তি এই কৃষি এবং এর হর্তা-কর্তারা, আমাদের কৃষক ভাইয়েরা। কিন্তু এই মেরুদণ্ডকে সোজা রাখার দায়িত্ব যাদের হাতে, সেই কৃষি দপ্তর এবং তার নিয়ম-কানুন কি পারে সেই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে?

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
Instagram Group Join Now



বর্তমান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন (বর্তমান পত্রিকা) চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে নিয়মের ফাঁক এবং দুর্বল নজরদারির কারণে আজও বাংলার কৃষক বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। শুধু বঞ্চনাই নয়, এই ফাঁকগুলো কাজে লাগিয়ে একশ্রেণির অসাধু মহল গড়ে তুলছে আর্থিক সাম্রাজ্য।

আমরা আজ এই প্রতিবেদনের গভীরে গিয়ে বুঝবো ঠিক কোন জায়গাগুলোতে ফাঁক থেকে যাচ্ছে, এর প্রভাব কী পড়ছে সাধারণ কৃষকের জীবনে এবং এই সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় কী হতে পারে।

Krishak Bandhu Loopholes
Krishak Bandhu Loopholes

রাজ্য সরকারের কৃষক বন্ধু প্রকল্প শুরু হয়েছিল চাষিদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃত চাষিকে খরিফ ও রবি মরশুমে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়ে উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, নিয়মের ফাঁক ব্যবহার করে প্রকৃত চাষির পরিবর্তে অনেক অযোগ্য ব্যক্তি এই সুবিধা নিচ্ছেন। ফলে একদিকে প্রকৃত কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছেন, অন্যদিকে সরকারের বিশাল অর্থ খরচও কাঙ্ক্ষিত ফল দিচ্ছে না।

কৃষক বন্ধু প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও আর্থিক চিত্র

প্রকল্প অনুযায়ী, একজন চাষি বছরে ৪,০০০ থেকে ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত সহায়তা পান। কৃষি সরঞ্জাম, বীজ, সার কিংবা জমির কাজে এই টাকা ব্যবহার করার উদ্দেশ্য নিয়েই প্রকল্প চালু হয়েছিল। শুধু নদীয়া জেলায় খরিফ মৌসুমে প্রায় ৬.৪১ লক্ষ কৃষককে দেওয়া হয়েছে ₹১৬৩ কোটি ৮৬ লক্ষ টাকা। অর্থাৎ, প্রকল্পটির আর্থিক প্রভাব যথেষ্ট বড় এবং বিস্তৃত।

নিয়মের ফাঁক দিয়ে অনিয়মের ঢল

১. জমি বিক্রয়ের নথি যাচাই না হওয়া

অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে জমি বিক্রি হয়ে গেলেও নতুন মালিক নন, আগের মালিক বা অন্য ব্যক্তি এখনও কৃষক বন্ধু প্রকল্পের সুবিধা নিচ্ছেন। এর কারণ হচ্ছে সঠিকভাবে জমির নথি যাচাই না হওয়া।

২. একই জমিতে একাধিক আবেদন

পরিবারের মধ্যেই লেনদেন: অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, এক পরিবারের বড় জমির মালিকানা তার বিভিন্ন সদস্যের নামে ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে। আইনত কোনো বাধা না থাকায়, পরিবারের একাধিক সদস্যই এই প্রকল্পের সুবিধা নিচ্ছেন, যদিও আদতে একটি পরিবারই সেই জমির মালিক।

একই জমিকে একাধিক শরিক বা পরিবারের সদস্যরা ভাগ করে দেখিয়ে আলাদা আলাদা ভাবে প্রকল্পের টাকা তুলছেন। ফলে এক জমি থেকে সরকারের একাধিক খরচ হচ্ছে, অথচ প্রকৃত চাষকাজ হয়তো হচ্ছে না।

যেমন ধরুন অনেকসময় একি পরিবারের মধ্যে জমি দান পত্র করেও সেই পরিবারের উভয়েই কৃষকবন্ধুর টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন….

যেমন ধরুন কোনও ব্যক্তির ১০ বিঘা জমির জনয় বার্ষিক ১০০০০ টাকা পেতেন, এখন তিনি তার পরিবারের কাউকে ৩ বিঘা জমি দানপত্র করে দিলেন এখন উভয়েই যথাক্রমে, ১০০০০ অবঙ্গ ৪০০০ টাকা করে পাচ্ছেন বার্ষিক।

৩. বেকার বা অচাষিদের অন্তর্ভুক্তি

প্রকল্পের উদ্দেশ্য কৃষকদের সহায়তা হলেও বাস্তবে এমন অনেক বেকার বা অচাষি রয়েছেন যারা কেবল জমির মালিকানার প্রমাণ দেখিয়ে টাকা পাচ্ছেন। এতে প্রকৃত কৃষকরা ধাক্কা খাচ্ছেন।

নজরদারি ও প্রশাসনের বক্তব্য

কৃষিদপ্তরের দাবি, আবেদন অনুযায়ী নথি যাচাই করেই তালিকা তৈরি হয় এবং অর্থ বিতরণ করা হয়। তবে যেভাবে অভিযোগ উঠছে, তাতে স্পষ্ট যে নজরদারির মধ্যে ফাঁক রয়ে যাচ্ছে। কাগজে-কলমে প্রক্রিয়া মেনে চললেও মাঠ পর্যায়ে বাস্তবতা ভিন্ন।

সমস্যার অন্তরালে মূল কারণ

  • জমির মালিকানার স্বচ্ছ তথ্য না থাকা।
  • ডিজিটাল নথি যাচাইয়ের অভাব।
  • পরিবারভিত্তিক জমি বিভাজনের সুযোগ কাজে লাগানো।
  • মাঠপর্যায়ে পর্যাপ্ত নজরদারি না থাকা।

সমাধানের পথ ও করণীয়

  1. জমির ডিজিটাল যাচাই – আধার ও জমির খতিয়ান একত্রিত করে ডিজিটালভাবে যাচাই করা গেলে একই জমি থেকে একাধিক আবেদন রোধ করা সম্ভব।
  2. জিও-ট্যাগিং ব্যবস্থা – জমির সঠিক ব্যবহার এবং মালিকানা নির্ধারণ করতে জিও-ট্যাগিং করা দরকার।
  3. নিয়মিত তদারকি – হঠাৎ পরিদর্শন ও সময় সময় পুনরায় যাচাই করলে ভুয়ো আবেদন ধরা পড়বে।
  4. স্বচ্ছ অনলাইন লেনদেন – আবেদন থেকে টাকা বিতরণ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ অনলাইনে ও ট্র্যাকেবল হলে দুর্নীতি অনেকটাই কমবে।

কৃষক বন্ধু প্রকল্প প্রকৃত অর্থে কৃষকদের আর্থিক ভরসা হয়ে উঠতে পারে, যদি নিয়মের ফাঁকগুলো বন্ধ করা যায়। আজ যেভাবে “বেনোজল” ঢুকে পড়ছে, তাতে প্রকল্পের উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে এবং সরকারের বিশাল অর্থের সদ্ব্যবহার হচ্ছে না। P ভবিষ্যতে যদি কঠোর নজরদারি, ডিজিটাল তথ্য যাচাই এবং আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ নিশ্চিত করা যায়, তবে এই প্রকল্প সত্যিই কৃষকের বন্ধু হয়ে উঠবে।

Leave a Comment